এই শিশুদের মারাত্বক কোন অসুস্থতা ছিল না, ছিল সাধারন সর্দি জ্বর বা অন্য কোন অসুখ যা হয়ত প্যারাসিটামল সিরাপে ভাল হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয় নি । প্যারাসিটামল সিরাপই তাদের মৃত্যুর কারন হয়েছে। হয়ত বাংলাদেশ বলেই সম্ভব হয়েছিল এই হত্যাযজ্ঞ। চলুন ঘুরে আসি সেই প্রেক্ষাপট থেকে।
১৯৯০ সাল। সহসাই শুরু হল এক ভয়াবহ মহামারি। প্রচুর শিশু হাসপাতালে ভর্তি হতে থাকল মারাত্বক কিডনি জটিলতা নিয়ে, যাদের প্রায় সবাই খুব অল্প সময়ের মাঝেই মারা যায়। কারন খুজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে সবার কিছু দিনের জ্বরের ইতিহাস ছিল। কিন্তু তার সাথে মেলানো যাচ্ছিল না ভয়াবহ কিডনি ফেইলুরের সম্পর্ক। ১৯৯২ সালে এই মহামারি নিয়ে কাজ করছিলেন শিশু কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডাঃ মোঃ হানিফ। তার নজরে আসে ১৯৯০ সালে নাইজেরিয়াতে ঘটে যাওয়া একই ধরনের ঘটনা। সেখানে সাধারন জ্বরে প্যারাসিটামল সিরাপ গ্রহন করার পর শিশুদের কিডনি নষ্ট হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল। সেই ঘটনার সুত্র ধরে বাংলাদেশে তদন্ত শুরু হয়।
পরীক্ষার জন্য বাংলাদেশের ২৮ ব্র্যান্ডের প্যারাসিটামল সিরাপ পাঠানো হয় ম্যাসাচুসেটসে একটি আমেরিকান সরকারি প্রতিষ্ঠানে। ৭টি ব্র্যান্ডের ওষুধে পাওয়া যায় বিষাক্ত ডাই-ইথাইল গ্লাইকল, যা এই কিডনি জটিলতার জন্য দায়ী। অভিযুক্ত ব্র্যান্ডের সিরাপ বিপনন বন্ধ করে দেয় সরকার এবং এই ধরনের কিডনি জটিলতা ৮৪% কমে যায়। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে ২০০৯ সালে। কিন্তু কেন ওষুধ ব্যবসায়ীরা এই বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশান প্যারাসিটামল সিরাপে?
প্যারাসিটামলকে সিরাপ আকারে দ্রবীভুত করতে প্রয়োজন হয় প্রোপাইলিন গ্লাইকল নামক কেমিক্যাল যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয়। ডাই-ইথিলিন গ্লাইকলে ও প্যারাসিটামল দ্রবীভূত করা যায়, যার মূল্য প্রায় প্রোপাইলিন গ্লাইকলের ২০% চেয়েও কম। ডাই-ইথিলিন গ্লাইকল ব্যবহৃত হয় ট্যানারি ও রাবার শিল্পে যা মানব দেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। অসাধু ব্যবসায়ীরা শুধুমাত্র অতিরিক্ত মুনাফার লোভে এই বিষ মিশিয়েছিল শিশুদের ওষুধে। ১৯৯০ সালে ৩৩৯ জন শিশু এই বিষে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরন করেছিল বলে বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত হতে পেরেছিলেন। বংগবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য মতে এই বিষাক্ত ওষুধে মারা গিয়েছে ২৭০০ শিশু। কিন্তু এই হত্যাযজ্ঞের বিচার কি বাংলাদেশে হয়েছে? ঘটনার ২৪ বছর পর ২৮ জন শিশুমৃত্যুর ঘটনায় একটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক সহ কয়েকজন কে ১০ বছরের সশ্রম কারাদন্ড এবং ২,০০,০০০ টাকা করে জরিমানা করা হয়। ঘটনার ভয়াবহতার সাথে এই শাস্তি কোন ভাবেই মেলানো যায় না। তবু সান্ত্বনা এটাই, বিচারহীনতার দেশে কিছু বিচার তো হয়েছে।
তথ্যসুত্রঃ
১। https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC2550149/
২। https://www.thedailystar.net/the-deadly-world-of-fake-medicine-37915
৩। https://www.dhakatribune.com/bangladesh/court/2016/11/28/acquitted-adulterated-paracetamol-case
৪। https://en.wikipedia.org/wiki/Diethylene_glycol
আরও পড়ুন
আপনি কতটা হৃদরোগের ঝুঁকিতে আছেন?